,

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : চমকের নাম সাহাবুদ্দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। গতকাল গণভবনে দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উপস্থিত ছিলেন শেখ রেহানাও। ছবি : পিআইডি

দেশের ২২তম রাষ্টপতি কে হচ্ছেন তা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে সব মহলে আলোচনা চলছিল। সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে চার-পাঁচজনের নাম নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের নেতারা গণমাধ্যমের সঙ্গে আভাসে-ইঙ্গিতে এই নামগুলো নিয়েই কথা বললেও নিশ্চিত করে কিছু বলেননি। গতকাল নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নামে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। এতে তিনিই হতে যাচ্ছেন দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি। দেশবাসীর কাছে এই খবর আসে বড় চমক হয়ে। কারণ শাহাবুদ্দিনের নাম নিয়ে কোনো আলোচনাই ছিল না সাধারণ মহলসহ গণমাধ্যমে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সংসদীয় দলের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী মনোনয়ন দিতে সর্বসম্মতিক্রমে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তিনি এ মনোনয়ন চূড়ান্ত করেন।

গতকাল রবিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এই নির্বাচনের নির্বাচনী কর্তার (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) দপ্তরে জাতীয় সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। গতকাল আর কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা পড়েনি। সে কারণে একক প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে আগামীকাল মঙ্গলবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।

নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের দুটি মনোনয়নপত্র সকাল ১১টায় ও ১১টা ৫ মিনিটে জমা দেওয়া হয়। মনোনয়নপত্র দুটি সোমবার (আজ) যাচাই করা হবে। মঙ্গলবার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় পার হলে তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।

নির্বাচনী কর্তার দপ্তরে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, চিফ হুইপ লিটন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, ফারুক খান, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।

এর আগে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে দেখা করে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন নিজে উপস্থিত ছিলেন। মনোনয়নপত্রে প্রস্তাবক হিসেবে ওবায়দুল কাদের এবং সমর্থক হিসেবে হাছান মাহমুদ সই করেন।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সংসদীয় দলের বৈঠকে রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী মনোনয়ন দিতে সর্বসম্মতিক্রমে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। তিনি এ মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন।’

জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘উনি ছাত্রজীবনে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এই নেতা পরে সরকারি চাকরিতে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অবিচল ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রচারবিমুখ হওয়ায় কখনো সামনে আসতেন না। দুদকের কমিশনার থাকার সময় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে বিদেশি চাপের কাছে মাথানত করেননি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সে সময় তিনি তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। পরে বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি।’

সাহাবুদ্দিনের পরিচিতি : বাবা শরফুদ্দিন আনসারী ও মা খায়রুন্নেসার সন্তানদের মধ্যে সবার বড় সাহাবুদ্দিনের  জন্ম  পাবনায় ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। মনোনয়নপত্রের তথ্য অনুযায়ী মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের স্থায়ী ঠিকানা হোল্ডিং নম্বর ৮৮/১, শিবরামপুর, সদর, পাবনা। ঢাকায় থাকেন গুলশানে। তিনি দীর্ঘদিন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি পাবনা অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পরে যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে জেলা যুবলীগের সভাপতি হন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে প্রতিবাদ জানান তিনি। সে সময় গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক বছর জেল খাটেন এবং নির্যাতনের শিকার হন। কারামুক্ত হয়ে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পাশাপাশি আইন পেশা শুরু করেন। একসময় তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেস ক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য।

১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে তিনি মুন্সেফ (সহকারী জজ) পদে যোগ দেন। বিচারিক কাজের পাশাপাশি তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার হিসেবেও দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ পদ থেকে অবসরে যান। তিনি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব পদেও নির্বাচিত হন।

মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা তদন্তে পরবর্তী সময়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে  মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত কথিত পদ্মা সেতুসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হিসেবে দলীয় সভাপতির মনোনয়ন পান। আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিরও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তিনি। এ ছাড়া দলের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান তিনি।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিকানায় ব্যাপক পরিবর্তন এলে জেডএমসি বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালের জুন মাসে ব্যাংকটির পরিচালক হন তিনি। পরে তিনি ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন।

মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুর নিবাসী আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা রেবেকা সুলতানার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রেবেকা সুলতানা সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান। তিনি বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্চ প্রগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান রনি দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের উচ্চপদে কর্মরত।

এই বিভাগের আরও খবর